লিখেছেন: সাইফ রুদাদ
শরীয়তপুর তো ইয়াবা ব্যবসায় জাতীয় পর্যায়ে চলে গেছে। এই জেলা থেকে প্রশাসন যাদের গ্রেফতার করছে দেখি তারা তো সারাদেশেরই। কিছুদিন পর হয়তো আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চলে যাবে। ক্ষমতাসীনদল , কথিত বিরোধীদল, প্রশাসন সবাই মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিতে অবস্থান করলে এহেন অবস্থা হয় কী করে? তাদের জিরো টলারেন্স নীতিতে কি কারও ইশারায় কোনো ফাঁক ফোঁকর আছে নাকি মাদক ব্যবসায়ীরাই রাজনৈতিক নেতা, প্রশাসন থেকে বেশি চৌকস? এই জেলায় দীর্ঘ নয় বছর বসবাসের পর যে বিষয়টা সবচেয়ে বেশি দেখেছি তাকে পাঁচটি ভাগে বিভক্ত করি আমি।
১. এক ধরণের অবিভাবক, যারা লক্ষ টাকার মালিক হওয়া সত্ত্বেও সন্তান লেখা পড়া করলে করুক না করলে না করুক নীতিতে সন্তান পালন করেন। ছেলে সন্তান একটু বড় হলে একটি বাইক কিনে দেন, তারপর ছেলেটি বাইক নিয়ে ইন্টার পাস অথবা অনার্স পড়ুয়া একটি মেয়ে নিয়ে ভো ভো দৌড়। প্রেমে ব্যর্থ হয়ে অথবা কারও থেকে কষ্ট পেয়ে মাদকে জড়ান, তারপর খোলে বাবার চোখ। কী আর করা, বাবা দেন পাঠিয়ে প্রবাসে। বিদেশ ফেরত ছেলেটি অনার্স পাস মেয়ে বিয়ে করে সংসার গোছান।
আরেক ধরণের ছেলে আছে যারা পড়াশোনায় কেউ এসএসসি পাস, কেউ ইন্টার পাস করেন এবং খুব কম সংখ্যক অনার্সে ভর্তি হোন। এদেরও অধিকাংশর পাছার নিচে বাইক থাকে এবং এক পর্যায়ে প্রেম, রাজনীতি, মাদকে জড়ান। তারপর বাবা বিদেশ পাঠান। ফিরে এসে মাস্টার্স পাস মেয়ে বিয়ে করে সংসার গোছান।
বর্তমানে আমার সাথে কিছু উঠতি যৌবনের ছেলে মেয়েদের সাথে কথা হয়, যারা প্রত্যেকেই বাইকের জন্য মরিয়া। এ তাদের দোষ নয়, এই সমাজের গঠনমূলক আলোচনা সমালোচনা করলে তাদের কোনো দোষ থাকে না কিন্তু তারা কি সেই পর্যন্ত পৌঁছেছে যে তারা বুঝবে বাইক হলে কোথায় নিয়ে যাবে তাকে?
২. বাবা কিছু টাকার মালিক এবং কিছুটা শিক্ষিত কিন্তু ছোট্ট একটা সমাজ বা গ্রাম নেতৃত্ব দেন। তাদের ছেলে মেয়েকে তারা খুব কষ্টে কিছুটা লেখা পড়া করান কিন্তু শেষ পর্যন্ত উপরিউক্ত ছেলেদের সাথে মিশে অধিকাংশই ঝড়ে পড়ে এবং কর্ম জীবনে এসে বাপের নাম ডাক শুনে মেয়ের বাবা মেয়ে বিয়ে দিলেও অনেকেরই সংসার টেকে না।
৩. গরীব বাবা। খুব কষ্টে সন্তানকে স্কুল কলেজে পাঠান কিন্তু শিক্ষকদের প্রাইভেট কোচিং বাবদ মন্টু দিতে না পাড়ায় ঝড়ে পড়ে। খুব কষ্টে কেউ কেউ পড়াশোনার কথিত শেষ ধাপ মাস্টার্স করতে পারলেও ঐ মন্টুর অভাবে ভালো কোথাও প্রতিষ্ঠিত হতে পারেন না। কোনো রকম খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকেন।
আর মেয়েরা! তারা কেন অনার্স, মাস্টার্স পাস করেন আমি বুঝি না আর তাদের শিক্ষকরাই বা কী শেখান যে, তাদের আত্মসম্মানবোধ সৃষ্টি হয় না? তারা অক্ষর জ্ঞানহীন, টিপসইওলা, আন্ডার এসএসসি, এসএসসি পাস ছেলে বিয়ে করেন? আর বিয়ে না করেই বা তাদের উপায় কী? এই দেশে তো নারীদের নেহাত যৌনবস্তু বা সন্তান উৎপাদনের মেশিন ছাড়া কিছু কল্পনা করা হয় না। তাদের সামাজিক প্রথা অনুযায়ী একটা নির্দিষ্ট বয়স হলে বিয়ে করতেই হবে নয়ত কলঙ্ক(?), অলক্ষুণ(?), অপায়া(?) ইত্যাদি। আর পাশ্ববর্তী দেশ, থাক সে কথায় না যাই। আমার সাথে ভালো রেজাল্ট করা এক বান্ধবীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম অনার্স তো শেষ করলি এখন প্লাণ কী? সে উত্তরে বলেছিল, স্বামী সন্তানকে দেখভাল করব, সংসার গোছাব। তারে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তাহলে অনার্স করলি কেন যদি নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ইচ্ছাটা নেই? সে নির্বিকার ছিল, জানিনা তার কোথায় সমস্যা। এইসব মেয়েদের শিক্ষা দিয়ে কী লাভ রাষ্ট্রের? গরীব কৃষকের, শ্রমিকের ট্যাক্সের টাকায় পড়াশোনা করে শুধুমাত্র স্বামী এবং সন্তানকে সার্ভিস দিবে এমন তো নীতি চিন্তা হতে পারে না। এদের মধ্যে অনেক মেয়ে আছে যারা ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও স্বামী, বাবা মার কুমানসিকতার কারণে দেশের সেবা, জনতার সেবা করতে পারেন না। আবার অনেক মেয়ে আছে যারা ছোট বেলা থেকেই এমন একটা পরিবেশে বড় হোন যে কল্পনাই করতে পারেন না যে নিজের পায়ে দাঁড়াবেন, কিছু একটা করবেন।
৪. জেলায় ভালো মানের কোনো কলেজ নেই, শরীয়তপুর সরকারি কলেজে শিক্ষার্থীদের জন্য নেই খেলার মাঠ, নেই ডিবেট ক্লাব, নেই পর্যাপ্ত জায়গা, যেখানে শিক্ষার্থীরা একটু বসবে, হাটবে, গল্প করবে, থিয়েটার করবে। কলেজে যে পরিমাণ শিক্ষার্থী আর যে পরিমাণ শিক্ষক তাতে কলেজ প্রশাসনকে কলেজ পরিচালনা করতে খুবই কষ্ট হয়, যা আমার নিজ চোখে দেখা। এই ক্লাসে শিক্ষক দিলো তো অন্য ক্লাস গোল্লায় কারণ শিক্ষক সংকট, এইসব সমস্যা নিয়ে কোনোদিন কোনো ছাত্রনেতা, জনপ্রতিনিধি বা অবিভাবকদের কথা বলতে দেখিনি। শিক্ষার্থী বেশি এবং ক্যাম্পাস ছোট হওয়ায় ক্যাম্পাসটিকে দু'টি ভাগে বিভক্ত করা জরুরি মনে করি কিন্তু কে বলবে এসব নিয়ে কথা? অন্যান্য কলেজগুলোর অবস্থান আরও খারাপ।
সরকারি বড় ধরণের আমলারা তাদের সন্তান একটু বড় হলেই পাঠিয়ে দেন অন্য কোনো জেলায় বা দেশের বাহিরে, তারা এছাড়া আর কী করবেন? তারা দুই দিনের অতিথি, অর্ডার এলো তো আজ আছেন কাল নেই। যোগদান করার পর স্বাভাবিক ভাবেই সকল বিষয়ের খোঁজখবর নেন, যখন জানতে পারেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এইরূপ অবস্থা তখন তার পারিবারিক সিদ্ধান্তের প্রথম সিদ্ধান্ত হয় ছেলে মেয়েকে এখানে রাখা যাবে না, আমি এমনটাই মনে করি। আর রাজনীতিবিদরা? বর্তমান, সাবেক নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি বা ক্ষমতা প্রাপ্ত বা ক্ষমতা হারানোরা তাদের ছেলে মেয়েদের কয়জন কোন ক্লাস পর্যন্ত পড়াশোনা করিয়েছেন শরীয়তপুরে তার হিসেব আপনারা আমার চেয়ে ভালে জানেন।
৫. শরীয়তপুরে নেই কোনো বিনোদন কেন্দ্র, মুক্তমঞ্চ, দু'একটি ছাড়া তেলবিহীন সাহিত্য সংগঠন বা চর্চা কেন্দ্র বা পার্ক। এককথায় নিজেকে বিকশিত করার মতন কোনো উপযুক্ত স্থান নেই। যেহেতু নেই সেহেতু অবসর সময় ছেলে মেয়েরা কোথায় যাবে? তাদের তো একটা জায়গা চাই, যেখানে নিজেকে গঠন করতে পারবে। আর এসব না থাকার কারণেই নষ্ট হচ্ছে ছেলে মেয়েরা। কেন এসব নেই জানার কৌতুহল থেকে যখনই জানতে চেয়েছি কোনো জনপ্রতিনিধি থেকে তখনই উত্তর পেয়েছি সরকারি জমিগুলো ডিসির নিয়ন্ত্রিত। আমরা চাইলেও পারি না। পূর্বের ডিসি স্যারকে একদিন জিগ্যেস করলে তিনি বলেন কেউ তো উদ্যোগ নেয় না, আমি তো রাজি। এভাবেই একে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সময়। আর এসবের সুযোগ নিয়ে শরীয়তপুরের সাবেক একজন কর্মকর্তা তার নিজ নামে শরীয়তপুর গণগ্রন্থাগারের পাশে করতে চেয়েছিলেন চত্ত্বর কিন্তু জেলার কিছু মেরুদণ্ডওলা বীর পুরুষ সেদিন সচেতন নাগরিক সমাজের ব্যানারে তাকে অতিথি পাখি বলে চত্ত্বরটি করতে দেননি। এটা করতে না দিয়ে ভালোই করেছেন সেদিন, আমিও এটার বিরোধিতা করেছিলাম সেদিন আপনাদের সাথে কিন্তু আপনারা কী উদ্যোগ নিয়েছেন এসব গঠনের ক্ষেত্রে আমার জানা নাই। ব্যক্তিগত ভাবে আমি সাইত্রিশটি জেলা ঘুরেছি আর কোনো জেলায়ই শরীয়তপুরের মতন এসপির বাড়ি এত বৃহৎ জায়গায় দেখিনি, ডিসির বাড়ি এত বৃহৎ জায়গায় দেখিনি। সরকারি অফিস আদালত গুলো এত বৃহৎ জায়গায় দেখিনি(হাতে গোনা কয়েটা ছাড়া)। এত বড় বড় আদালত চত্ত্বর, ডিসি-এসপির বাড়ি কী অর্থ প্রকাশ করে তা বেঁচে থাকলে বরেণ্য বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফা বা হুমায়ুন আজাদকে জিজ্ঞেস করতাম। শ্রদ্ধেয় আহমদ মওদুদ বলতেন পাড়ায় পাড়ায় পুলিশ ফাড়ি নয়, লাইব্রেরি গড়ে তুলুন। এই কথার মর্ম আমি যা বুঝি তা হলো, পুলিশ দিয়ে অপরাধ ঠেকানো যায় না, লাইব্রেরি তথা জ্ঞান দিয়ে ঠেকানো যায়। কিন্তু শরীয়তপুরে খেয়াল করবেন প্রত্যেক থানা উপজেলায় কী বিশাল আয়োজনে হচ্ছে পুলিশ অফিস।
শরীয়তপুরের অনেক অনার্স পড়ুয়া শিক্ষার্থীকে দেখেছি যারা পাঠচক্র, ডিবেট, থিয়েটার চিনে না এমনকি পাঠ্য বইয়ের বাইরের বইকে বাংলা চটি বই হিসেবে জ্ঞান করে। সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গুলোর নেতৃত্বে থাকেন ক্ষমতাসীন দলের হর্তাকর্তারা, সে যে দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন। অথচ সংস্কৃতি চর্চা করতে হলে চাই মুক্ত মত প্রকাশের জায়গা যা বাংলাদেশের বৃহৎ দুই দলের নেতাদের নিকটই অসম্ভব। এই জেলায় বিগত বিশ/ত্রিশ বছরের মধ্যে জাতীয় পর্যায়ে হাতে গোনা দুই একজন ছাড়া কোনো বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নেই। কেউ থাকলেও তিনি জন্মগতভাবে শরীয়তপুরের সন্তান হলেও বড় হয়েছেন অন্য কোনো জেলায় বা বিদেশে। প্রত্যেক বছর ফেব্রুয়ারি আসলে প্রশাসন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আয়োজন করে বইমেলার। যেখানে বইয়ের চেয়ে বেশি চুড়ি-বালা-লিপিস্টিকের দোকান থাকে। আর মঞ্চে থাকে ভাড়াটিয়া সাংস্কৃতিক কর্মী। স্থানীয় মুষ্টিমেয় যারা সাংস্কৃতিক চর্চা করেন তারা সেখানে হোন কোণঠাসা। আবার এই মুষ্টিমেয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদেরই দেখা যায় তাদের কবিতা বা সাহিত্যানুষ্ঠানে ডিসি-এসপিকে রাখেন অতিথি। আমলারা কী বোঝেন সাহিত্যের বা তারা দেশের সাহিত্যের ইতিহাসে কতটুকই রেখেছেন অবদান বা কী ছিল তাদের ভূমিকা? তা এদেশের বোধজ্ঞান সম্পন্ন প্রত্যেক সাংস্কৃতিক কর্মীই জানেন। যে আমলারা উপরের নির্দেশে লেখক কবিতা, গল্প লেখার কারণে গ্রেফতার করেন, তুলে নেন, মামলা দেন, নিষিদ্ধ করেন তাদের কেন ডাকেন আমি বুঝি না। আর ডিসি-এসপিই বা কী করবেন, তারা জেলার অথিতি। কবি-সাহিত্যিকরা ডেকেছেন না গেলে যদি বুদ্ধিজীবী মহাদোয়রা মাইন্ড খান সেই ভেবে তারাও যান।
এখানে নেই পর্যাপ্ত খেলার মাঠ, যার কারণে ক্রিকেট, ফুটবলসহ সকল প্রকার খেলায় চলে জুয়া। ক্রীড়া চর্চা করতে গিয়ে এখানে ভালোর চেয়ে বেশি মন্দই হয়। এখানে পেশাদার জুয়া খেলোয়াড় বছরে যে টাকা জুয়া খেলায় নাড়াচাড়া করেন তার চেয়ে বেশি টাকা ক্রিকেট, ফুটবল ইত্যাদিতে নাড়াচাড়া হয়।
এই জেলায় ছিলেন উপমহাদেশ বিখ্যাত অতুল প্রসাদ সেন, আবু ইসহাকরা। ছিলেন শান্তি সেন, আব্দুর রাজ্জাকের মতন রাজনীতিবিদরা। কিন্তু তারা এবং বর্তমান রাজনীতিবিদরা শুধু উন্নতিই করে গেলেন কিন্তু কি উন্নত করলেন মশাই? যেখানে ছেলে পিলে মাদকে নষ্ট হয়, উন্নত মানসিক জ্ঞানের অভাবে অপরিণত যৌবনেই নষ্ট হয়ে যায় যৌবনের অশুভ ইশারায় সেখানে এসব সমস্যার সমাধান না করে যে বড় বড় পদ্মা সেতু, রাস্তাঘাট, দালান কোঠা করলেন তা দিয়ে শরীয়তপুরবাসী কী করবে? এই পদ্মা সেতু তো শহিদুল্লা কায়সারের সংশপ্তক উপন্যাসের সেতু হবে, রাস্তা হবে যা দিয়ে জীবন ধ্বংসী সরঞ্জাম আসবে শরীয়তপুরে, এই দালানকোঠাতো মাদকের কারখানা হবে, ধর্ষকের নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্র হবে। এত এত পুলিশ ফাঁড়ি আর সৈন্যবাহিনী দিয়ে ঠেকাতে পারবেন সেদিন সেই নষ্টদের মিছিল? দেয়ালে পিঠ ঠেকার যে কিঞ্চিৎ সময় এখনও আছে, তা দিয়ে জেলাটাকে সাজান একটি শিক্ষিত, মানবিক, বুদ্ধিচর্চার আতুরঘর, সাংস্কৃতিক চর্চার কেন্দ্র আর গঠনমূলক আলোচনা সমালোচনার রাজনীতির প্রথম বিদ্যাপীঠ হিসেবে। মানুষ আপনাদের মনে রাখবে অনন্তকাল অবধি।
আসুন নিজ থেকে সচেতন হই, নিজের ও প্রজন্মের ভবিষ্যৎ রক্ষায় আপন জেলাকে গড়ে তুলি আগামির স্বর্গ করে।
0 মন্তব্যসমূহ
অনাকাঙ্ক্ষিত মন্তব্যের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়