আপনার সেরা লেখাটা শৈশব পত্রিকায় প্রকাশের জন্য পাঠিয়ে দিন।

শৈশব

মৈমনসিংহ গীতিকার মহুয়া পালার আলোচনা পর্ব ০১


লিখেছেন: সাইফ রুদাদ
দ্বিজ কানাই প্রণীত মৈমনসিংহ-গীতিকায় বাঙালির আজন্ম আবেগ, প্রেম, ঐতিয্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। শ্রীযুক্ত চন্দ্রকুমার দে সংগ্রহিত, স্যার শ্রীদীনেশচন্দ্র সেন সম্পাদিত মহুয়া পালা ও দেওয়ানা মদিনা আমার সুখপাঠ্য। 'সৌরভ' পত্রিকার সম্পাদক শ্রীযুক্ত কেদারনাথ মজুমদার, শ্রীযুক্ত চন্দ্রকুমার দে, শ্রীযুক্ত দিনেশচন্দ্র সেন, স্যার শ্রীযুক্ত আশুতোষ মুখোপাধ্যায়সহ যাঁরা মৈমনসিংহ গীতিকা সংগ্রহে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন তাঁদের প্রতি স্বশ্রদ্ধ সালাম, নমষ্কার রেখে আজ আমি মহুয়া পালার সুখ খুঁজার চেষ্টায় নিন্মের লেখাখানি লেখলাম। মহুয়া (প্রাচীন পল্লীনাটিকা) শুরুতেই 'বন্দনাগীতি' পূবেতে বন্দনা করলাম পুবের ভানুশ্বর। একদিকে উদয়রে ভানু চৌদিকে পশর।। দক্ষিণে বন্দন গো করলাম ক্ষীর নদী সাগর। যেখানে বানিজজি করে চান্দ সদাগর।। উত্তরে বন্দনা গো করলাম কৈলাস পরবত। যেখানে পড়িয়া গো আছে আলীর মালামের পাথথর।। পশ্চিমে বন্দনাগো করলাম মক্কা এন স্থান। উরদিশে বাড়ায় ছেলাম মমিন মুসলমান।। সভা কইর্যা বইছ ভাইরে ইন্দু মুসলমান। সভার চরণে আমি জানাইলাম ছেলাম।। চাইর কুনা পিরথিমি গো বইন্ধ্যা মন করলাম স্থির। সুন্দর বন মুকামে বন্ধলাম গাজী জিন্দাপীর।। আসমানে জমিনে বন্দলাম চান্দে আর সূরুয। আলাম-কালাম বন্দুম কিতাব আর কুরাণ। কিবা গান গাইবাম আমি বন্দনা করলাম ইতি উস্তাদের চরণ বন্দলাম করিয়া মিন্নতি। (সমাপ্ত) এই বন্দনাগীতিটি স্পষ্ট একজন মুসলমান গায়েনের রচিত। গায়েন প্রথমেই বন্দনা করেছেন পূবের ভানুশ্বরের। ভানুশ্বর শিব। শিবের একদিকে উদয় আর চারদিকে প্রকাশ। আবার ভানু অর্থ সূর্য, সূর্যেরও পূবদিকে তথা একদিকে উদয় চারদিকে পশর। তারপর বন্দনা ক্ষীর নদী সাগরের, এখানে চাঁদ সওদাগর বানিজ্য করে। ব্যবসা করে মুসলমানের যে সাফল্য হয়ত তার প্রতিই গায়েনের শ্রদ্ধা। এরপর কৈলাস পর্বতের বন্দনা, যেখানে হযরত আলীর পায়ের চিহ্নের পাথর আছে। পশ্চিমে বন্দনা করেছেন মক্কার, মক্কার দিকে মুসলমান সালাম পাঠিয়ে থাকে। সভায় উপস্থিত হিন্দু মুসলমান সবাইকে গায়েন সালাম করেছেন। চাইর কোণায় পৃথিবিকে বেঁধে মন স্থির করে গায়েন সুন্দরবনের দিকের জিন্দাপীর গাজীকে বন্দনা করেছেন। উল্লেখ্য সুন্দরবনের ব্যাঘ্রের দেব দক্ষিণরায়ের সঙ্গে গাজির (উক্ত পীরের) যুদ্ধের কথা অনেক পুস্তকেই আছে, যেমন: রায়-মঙ্গল। সর্বশেষ গায়েন আকাশ ও জমিনে বন্দনা করেছেন চাঁদ আর সূর্যকে এবং ঈশ্বরের কোরাণকেও বন্দনা করেছেন। বিনয়ী হয়ে গায়েন বন্দনা শেষে বলেছেন কি গান তিনি গাইবেন? এই বিনয় বাঙালির আজন্ম আচার। ওস্তাদের কথা স্মরণ করে তিনি ওস্তাদের প্রতি মিনতি করে তার চরণ বন্দনা করেই তিনি গাওয়া শুরু করেছেন। (০১) হুমরা বেদে হুমরা বেদে ডাকাতের সর্দার ছিল। তার ছোট ভাই মাইনকা(মানিক)। তারা বনে বাস করত। বেদে হুমরা ও মাইনকা ভ্রমণ করতে করতে ধনু নদীর পারে কাঞ্চনপুর গ্রামে উপস্থিত হলো। কাঞ্চনপুরে ছিল এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ তার ছিল পরম সুন্দরী ছয় মাসের এক কণ্যা। হুমরা বেদে সেই কণ্যা চুরি করল। গীতিকায়.... ভরমিতে ভরমিতে তারা কি কাম করিল। ধনু নদীর পারে যাইয়া উপস্থিত অইল।। কাঞ্চনপুর নামে তথা আচিল গ্রাম। তথায় বসতি করত বির্দ্দ এক বরাম্মন।। ছয় মাসে শিশু কইণ্যা পরমা সুন্দরী। রাত্রি নিশিকালে হুমরা তারে করল চুরি।। ছয় মাসের শিশু কণ্যা এক বছরের হলো, কোলে কাখে করে হুমরা তাকে পালতে লাগল। এক দুই তিন করে ষোল বছর গেলে হুমরা তাকে বাইদানিদের খেলা শেখায়। বাইদ্যার এই নন্দীনিকে যে দেখে সেই পাগল হয়। আর এই রূপসী কণ্যাকে নিয়ে হুমরা ত্রিভুবন ভ্রমণ করে। গীতিকায়..... বাইদ্যা বাইদ্যা করে লোকে বাইদ্যা কেমন জনা। আন্দাইর ঘরে থুইলে কন্যা জ্বলে কাঞ্চা সোনা।। হাট্টিয়া না যাইতে কইন্যার পায়ে পরে চুল। মুখেতে ফুট্টা উঠে কনক চাম্পার ফুল।। আগল ডাগল আখিরে আসমানের তারা। তিলেক মাত্র দেখিলে কইন্যা না যায় পাশুরা।। বাইদ্যার কইন্যার রূপে ভাইরে মুনীর টলে মন এই কন্যা লইয়া বাইদ্যা ভরমে তিরভুবন।। এমন সুন্দরী কণ্যা পেয়ে হুমরা বাইদ্যা কণ্যার নাম রাখে 'মহুয়া সুন্দরী'। (০২) গাড়ো পাহাড়; বনপ্রদেশ হুমরা বাইদ্যা তার ছোট ভাই মাইনকিয়াকে বলে চলো ভাই, খেলা দেখাতে বিদেশ যাই। মাইনকা বাইদ্যা বলে শুক্রবার সকালে আমরা বিদেশ যাব। শুক্রবার সকালে তারা গাট্টীবোচকা নিয়ে বিদেশ যাত্রা করে। এই গাট্টীবোচকা বহন বাঙালির চিরদিনের। তাদের সাথে নিয়েছে তোতা, ময়না, টিয়া, দোয়েল (খাঁচায় ভরে), ঘোড়া, গাধা, রাও চন্ডালের হাড়, শিকারি কুকুর, শেয়াল, সজারু। এগুলো নেওয়ার অর্থ বাঙালি আগে দূরে কোথাও গেলে বাড়ির পশু পাখি নিয়ে যেত। এ বাঙালির সংস্কৃতি। এসব কথা আমাদের ঠাকুমা, দাদা বয়স্ক লোকের মুখে শোনা যায়। রাও চন্ডালের হাড় হলো চন্ডালদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির হাড় যা দিয়ে বেদেরা বাজি করার সময় তাদের দ্রব্যাদিতে ঠেকিয়ে নানারূপ অদ্ভূত ক্রিয়া করে থাকে। দলে সবার আগে হুমরা, তারপর মানিক এবং তার পেছনে দলের লোক। গীতিকায়..... হুমড়া বাইদ্যা ডাক দিয়া কয় তাইনকিয়া ওরে ভাই। খেলা দেখাইবারে চল বৈদেশেতে যাই।। মাইনকিয়া বাইদ্যা কয় ভাই শুন দিয়া মন। বৈদেশেতে যাব আমরা শুক্কুর বাইর্যা দিন।। শুক্কুর বাইর্যা দিন আইল সকালে উঠিয়া। দলের লোক চলে যত গাট্টীবুচকা লইয়া।। আগে চলে হুমরা বাইদ্যা পাছে মাইনকিয়া ভাই। তার পাছে চলে লোক লেখা জুখা নাই।। বাশ তাম্বু লইল সবে দড়ি আর কাছি। * * * * * * * । এখানে উল্লেখ্য *(স্টার) চিহ্নিত ছত্রটি পাওয়া যায় নাই। তাদের সঙ্গে মহুয়া সুন্দরীও চলছে, সে পালঙ্গ সইয়ের গলা ধরাধরি করে চলছে। বাঙালি যুবতীরা সইয়ের গলা ধরে হাঁটতে পছন্দ করে। এক দুই তিন মাস পার হলে তারা সবাই বামনকান্দা গ্রামে পৌঁছাল। গীতিকায়...... তারও সঙ্গেতে চলে মহুয়া সুন্দরী। তার সঙ্গে পালঙ্গ সই গলা ধরাধরি।। এক দুই তিন করি মাস গুয়াইল। বামনকান্দা গ্রামে যাইয়া উপস্থিত হইল।। (০৩) নদের চাঁদের সভা [ নদের চাঁদ= এ নামটিতে বুঝা যায় গানটি ৩০০ বছর পূর্বে রচিত হলেও তদুর্দ্ধ কালের নয়, এ গান চৈতন্য প্রভুর পরবর্তী, কারণ চৈতন্য প্রভুর পূর্বে কারও নাম নদের চাঁদ হতে পারত না।] ঠাকুর নদের চাঁদ সভায় বসে আছেন। তার আগে পাছে লোক বসে আছেন। সেখানে লেংড়া* সালাম জানায়ে প্রবেশ করল।বলল, শোনো নদের চাঁদ নতুন একদল বাইদ্যা আসছে তামসা দেখানোর জন্যে। পরম সুন্দরী কন্যা তাদের সঙ্গে। গীতিকায়.... পরম সুন্দরী কন্যা সঙ্গেতে তাহার। জন্মিয়া ভন্মিয়া এমুন দেখি নাইকো আর।। একথা শুনে নদের চাঁদ তার মাকে গিয়ে বলল মাগো আর কিছু চাই না। একদল নতুন বেদে আসছে যদি আদেশ করো তবে তামসা করাতে চাই। মা জানতে চায় কত টাকা লাগে তামসা করাতে। নদের চাঁদ বলল একশ টাকা লাগে। মায়ের অনুমতি তামসা করাতে। গীতিকায়..... শুন শুন নদের চাঁদ বলি যে তোমারে। বাইদ্যার তামসা করাও নিয়া বাইর বাড়ীর মহলে।। *উল্লেখ্য পূর্ব কালে, রাজ-অন্তঃপুরে যাতায়াতের জন্যে বিকলাঙ্গ ব্যক্তি নিযুক্ত হত। (০৪) খেলা-প্রদর্শন হুমরা বেদে ভাই মাইনকাকে বলে চলো ধনু কাডি নিয়া তামসা করতে যাই। যখন হুমরা বেদে ঢোলে বাড়ী মারল তখন নদ্যাপুরের সব মানুষের দৌড়াদৌড়ি লাগল, একজন আরেকজনকে ডেকে বলল চল তামসা দেখতে যাই। চারদিক ঘিরে লোকজন তামসা দেখতে লাগল, নদের চাঁদ মধ্যে বইয়া উকি ঝুকি মারতে লাগল। বেদের বহরের ঢোলের বাড়ী আর গাঁয়ের লোকজনের ছোটাছুটি, পাড়া পড়শিকে ডেকে নিয়ে খেলা দেখা বাঙালির আজন্ম চরিত্র। আর মধ্যে বসে আছেন নদের চাঁদ তিনি গাঁয়ের মাদবর শ্রেণীর তাই। তারপর হুমরা বেদের মেয়ে যখন বাশে নাড়া দিল তখন হৈ চৈ পরে গেল। গীতিকায়..... যখন নাকি বাইদ্যার ছেরি বাশে মাইলো লাড়া। বইসা আছিল নদ্যার ঠাকুর উঠ্যা ঐল খাড়া।। হুমরা বেদের মেয়ে মহুয়া সুন্দরী যখন দড়ি বাইয়া বাশে উঠে নানারূপ ভঙ্গিতে বাজি করতে লাগল তখন নদের চাঁদের মনে মহুয়া সুন্দরীর প্রতি প্রেম জাগে। তার মুখ ফুটে বলে ফেলা কখন জানি পরে গিয়ে মরে যায় মহুয়া সুন্দরী। বলা যায় এখানেই প্রেমের সূত্রপাত। গীতিকায়....... দড়ি বাইয়া উঠ্যা যখন বাশে বাজী করে। নইদ্যার ঠাকুর উঠ্যা কয় পইর্যা নাকি মরে।। হুমরা বেদের দল গানে গানে বলতে থাকে গান করতে এলাম নদ্যা ঠাকুর বাড়ি। ইনাম বক্সিস চাই। কিন্তু মনে মনে বলে যেন নদ্যা ঠাকুরের মন পাই। তারা হাজার টাকার শাল নিল, টাকা নিল। হুমরা বেদে বসবাসের জন্যে বাড়ি চাইল। নদের চাঁদ বাড়ি দিল, চাল দিল, ডাল দিল। তারা নতুন বাড়িতে থাকতে লাগল। কিন্তু ক্রিয়াশীল বায়ুতে মহুয়ার জ্বল এলো। মহুয়া দেশে ফিরতে চাইলে হুমরা বেদে নতুন বাড়িতে লাগানো বেগুন, উড়ি তথা সিম, কচু, কলা বিক্রি করে মহুয়ার জন্যে হাড়, বাজু, গলার মালা কিনবে বলে তাকে সান্ত্বনা দেয়, কাঁদতে নিষেধ করে। আর বলে তুমি না থাকলে আমার গলায় ছুরি। এই তো বেদের বহরের চিরদিনের রূপ। ছোট বেলায় আমরা দেখতাম, বেদেরা গাঁয়ে এসে গাঁয়ের সহজ সরল বউ-ঝিদের নানা রোগ শোকের কথা বলে তার প্রতিকার করবে বলে টাকা, হাঁস, মুরগী, চাল, ডাল ইত্যাদি নিয়ে যেত। বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে দশ বছর আগে খেলা দেখিয়ে তাদের অন্ন জুটত না বলে তারা গাঁয়ে ঢুকে রোগ শোকের কথা বলে রোজগার করত কিন্তু শত শত বছর আগে মানুষের বিনোদনের মাধ্যম এই বেদে, যাত্রা পালা ইত্যাদিই ছিল। এভাবেই বেদের বহরের চিরদিনের রূপ প্রতিফলিত এই হুমরা বেদে বহন করে চলছে। গীতিকায়...... বাজী করলাম তামসা করলাম ইনাম বক্সিস চাই। মনে বলে নদ্যার ঠাকুর মন যেন তার পাই।। হাজার টেকার শাল দিল আরো টেকা কড়ি। বসত করতে হুমরা বাইদ্যা চাইল একখান বাড়ি।। ডাইল দিল চাইল দিল রসুই কইর্যা খাইও। নতুন বাড়ীত খাইয়া তোমরা সুখে নিদ্রা যাইও।। বেদের বাড়ির রূপ অঙ্কিত হয়েছে এভাবে...... নয়া বাড়ী লইয়ারে বাইদ্যা বানলো চৌকারী। চৌদিকে মালঞ্চের বেড়া আয়না সাড়ি সাড়ি।। হাস মারলাম কইতর মারলাম ব্যাচ্যা মারলাম টিয়া। ভাল কইরা বাইন্দো বেনুন কাল্যাজিরা দিয়া।। উল্লেখ্য, চৌকারী অর্থ চৌচালা ঘর। হমরা বেদে হাঁস, কবুতর এবং বেছে ভালো টিয়া জবাই করছেন রান্নার জন্যে। (০৫) নদ্যার ঠাকুরের সঙ্গে মহুয়ার জলের ঘাটে দেখা একদিন সন্ধ্যা বেলা নদের চাঁদ পথে রওয়ানা করে এমন সময় তামসা শেষে মহুয়া সুন্দরী বাড়ি ফেরে সেই পথে। নদের চাঁদ তাড়াতাড়ি করে বলে তোমার সাথে মনের কথা বলব, তুমি সন্ধ্যা বেলা জলের ঘাটে এসো। গীতিকায়..... সইন্ধ্যা বেলায় চান্নি উঠে সূরুয বইসে পাটে। হেন কালেতে একলা তুমি যাইও জলের ঘাটে।। নদের চাঁদের ইচ্ছা মহুয়া একলা জলের ঘাটে গেলে তার কাঙ্কে ভরা কলসী তুলে দিবে সে। গীতিকায়.... সইন্ধ্যা বেলা জলের ঘাটে একলা যাইও তুমি। ভরা কলসী কাঙ্কে তোমার তুল্যা দিয়াম আমি।। সন্ধ্যা বেলা কলসী নিয়া মহুয়া জলের ঘাটে গেলে নদের চাঁদ সেখানে যায় এবং বলে জল ভরো সুন্দরী কন্যা জলে দিয়ে মন গতকাল যে বলছিলাম কথা তা কি স্মরণ আছে? মহুয়ার সরল উত্তর তুমি ভিন দেশি পুরুষ, তোমার গতকালের কথা আমার মনে নেই। নদের চাঁদের জবাব গীতিকায় শুনি... নবীন যইবন, কইন্যা ভুরলা তোমার মন এক রাতিরে এই কথাটা হইলে বিস্মরণ। মহুয়ার জবাব... তুমি ত ভিন দেশী পুরুষ আমি ভিন্ন নারী তোমার সঙ্গে কইতে কথা আমি লজ্জায় লজ্জায় মরি। নদের চাঁদের জবাব... জল ভর সুন্দরী কইন্যা জলে দিছ ঢেউ। হাসি মুখে কওনা কথা সঙ্গে নাই মোর কেউ।। তারপর নদের চাঁদের জানার ইচ্ছা, কে তোমার মাতা পিতা, এই দেশে আসার আগে কোথায় ছিলে। মহুয়ার জবাব গীতিকায়..... নাহি আমার মাতা পিতা গর্ভ* সুদুর ভাই। সুতের হেওলা অইয়া ভাইস্যা বেড়াই।। কপালে আছিল লিখন বাইদ্যার সঙ্গে ফিরি। নিজের আগুনি আমি নিজে পুইরা মরি।। এই দেশে দরদী নইরে কারে কইবাম কথা। কোন জন বুঝিবে আমার পুরা মনের বেথা।। মনের সুখে তুমি ঠাকুর সুন্দর নারী লইয়া। আপন হালে করছ ঘর সুখেতে বান্দিয়া।। *(স্টার) চিহ্নিত গর্ভ শব্দটি এখানে দ্বিরুক্তি। চর্যাগীতিকায় আমরা পাই 'হরিণা মাংসে আপনা বৈরী'। হরিণ তার নিজের সুস্বাদু মাংসের কারণে নিজ প্রাণ বাঁচাতে তার কষ্ট হয়। এখানেও দেখতে পাওয়া যায়। মহুয়ার নিজ যৌবনে নিজে পুরে মরছে কিন্তু দুঃখ বলবে কারে? ঠাকুর নদের চাঁদের প্রতি ঈর্ষা মহুয়ার। তার ধারণা নদের চাঁদ সুন্দর নারী লইয়া আপন হালে সুখের সংসার করছে কিন্তু নদের চাঁদের অবস্থান...... ঠাকুর বলে কইন্যা তোমার শানে বান্ধা হিয়া। মিছা কথা কইছ তুমি না কইরাছি বিয়া।। তারপর মহুয়ার উক্তি কঠিন তোমার মাতা পিতা, এমন যৌবন কালে তোমাকে বিয়া দেয় নাই। নদের চাঁদেরও জবাব... কঠিন আমার মাতা পিতা কঠিন আমার হিয়া। তোমার মত নারী পাইলে করি আমি বিয়া।। মহুয়ার জবাব.... লজ্জা নাই নির্লজ্জ ঠাকুর লজ্জা নাইরে তর। গলায় কলসী বাইন্দা জলে ডব্যা মর।। নদের চাঁদের জবাব.... কোথায় পাব কলসী কন্যা কোথায় পাব দড়ী তুমি হও গহীন গাঙ্গ আমি ডুব্যা মরি।। আমরা খুলনা যশোরের অষ্টক পালার শ্রীকৃষ্ণের লীলাবিষয়ক গানে পাই.... আমার মত সুন্দর রাধে যদি পেতে চাও গলাতে কলসীতে বাইন্ধা যমুনাতে যাও কোথায় পাব হার কলসী কোথায় পাব দড়ী তুমি হও যমুনা রাধে আমি ডুইবা মরি। মৈমনসিংহ গীতিকার মহুয়া, নদের চাঁদ কখনও বাংলার গাঁও গেরামের সাধারণ বেদে, চাষী আবার স্বর্গ থেকে আগত রাধা-কৃষ্ণ। এ আমার আবহমান বাংলার চিরদিনের চরিত্র। [দ্র. মহুয়া পালার ২৪ টি পালার মধ্যে এখানে মাত্র ৫ টি পালার কথা আমরা জেনেছি। পর্যায়ক্রমে ২৪ টি পালাই আলোচনা করব আশা ব্যক্ত করে প্রিয় পাঠকের জন্যে শুভ কামনা রেখে আজকের মত শেষ করছি। মজার ব্যপার, এখনও মৈমনসিংহ, কিশোরগঞ্জ এলাকায় ও-কার কে উ-কার ব্যবহার করে। প্রিয় পাঠক, উপরে দেখা গেছে কোনো কোনো শব্দে চ ব্যবহার করা হলেও পুনরায় সেই শব্দেই আবার ছ ব্যবহার করা হয়েছে। এরকম অনেক শব্দ একেক স্থানে একেক রকম ভাবে লেখা হয়েছে। প্রিয় পাঠক শ্রীযুক্ত দীনেশ চন্দ্র সেনও একই রকম শব্দ একেক স্থানে একেক রকম ব্যবহার করায় উক্ত শব্দগুলো সব স্থানে একরকম করে লেখার দুঃসাহস আমার হয় নাই।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ