আপনার সেরা লেখাটা শৈশব পত্রিকায় প্রকাশের জন্য পাঠিয়ে দিন।

শৈশব

শিশুর স্বাধীন বিকাশ ও পছন্দ মূল্যায়নের সামাজিক দায়িত্ব

লিখেছেন: জি কে সাদিক

প্রত্যেক মানব শিশুই জন্মগতভাবে অন্যের থেকে মেধা ও মননে, চিন্তা ও কর্মে, বুদ্ধিমত্বায়, রুচিবোধ নিয়ে জন্মায়। জন্মের পরবর্তী পরিবেশের আলোকে সে নিজেকে বিকশিত করার সুযোগ পায়। আবার কেউ পায় না। ছোট থেকে লালন-পালন, পরিবারের আচরণ, জীবনপদ্ধতি শিশুর পরবর্তী বিকাশে সব চেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে। তাদের বেড়ে উঠার পরিবেশের উপর ভিত্তি করে প্রতিভার চর্চাতেও ভিন্নতা লক্ষ করা যায়। কেউ হয়তো খেলাধোলায় খুব ভালো করে, কেউবা ভালো গান করে, কেউবা নৃত্য কিম্বা নতুন কিছু একটা করতে আগ্রহবোধ করে। এমন অনেক শিশু-কিশোর আছে যাদের সামনে নতুন কিছু মানে রহস্যময় কিছু। তারা সেই রহস্যভেদ করতে চায়। যেমন অনেক শিশু আছে যারা নতুন কোনো কিছু পেলেই সেটা খুলে ওর ভেতরে কী আছে সেটা দেখার জন্য সেটা খুলে ফেলে। এটা তার মনের কৌতূহল। অনেক ছোট বাচ্চাদের প্রশ্ন করার প্রবণতা এতো বেশি যে তা বড়দেরকে রীতি মতো বিরক্ত করে তুলে। এসবের কোনোটাই তার নৈতিবাচক গুণ নয়। সবই তার মনের কৌতূহল। নতুনকে জানবার প্রবল ইচ্ছে। বড় কিম্বা পরিবারের উচিত তার এই ইচ্ছেকে জিইয়ে রাখা, তাকে সামনে চলতে সাহস দেয়া তার কৌতূহলের চূড়ান্ত মিমাংসা করতে সহায়তা করা। তাকে থামানো কখনই উচিত না। যখনই তাকে থামানো হবে বা তার আচরণের প্রতি বিরক্তবোধ প্রকাশ করা হবে তখন সে মানসিকভাবে জানার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। তখন সে লুকিয়ে কিছু করতে চাইবে। এই প্রবণতাই তাকে ভিন্ন পথে পরিচালিত করবে। পরিবারের কিম্বা বড়দের গুরু দায়িত্ব হচ্ছে ছোটরা কোন ভালো কাজের প্রতি বিশেষ আগ্রহবোধ করছে সেটার প্রতি খেয়াল রাখা এবং তাকে উৎসাহিত করা। ভুল কিছু করতে তখন তাকে বুঝিয়ে দেয়া। এবং যখনই সন্তানের বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে তখন তার মানসিকতার দিকে খেয়াল রাখা উচিত। সে আসলে কী চায় কিম্বা তার পছন্দ কী সেটা খেয়াল রাখা জরুরী। সন্তান যদি গান করতে পছন্দ করে তাকে সেই দিকেই উৎসাহিত করা, তার আগ্রহকে গুরুত্ব দেয়া এবং তাকে সেই পথেই পরিপক্ক হতে প্রয়োজনীয় এবং সাধ্যের মধ্যে যতটা সম্ভব তাকে সহায়তা করা উচিত। মনে রাখা দরকার জগতের সব শিশুই ডাক্তার হবে না, শিক্ষক হবে না, ইঞ্জিনিয়ার হবে না কিম্বা আর যা যা ভাবি তা হবে না। সবাই মেডিক্যালে কিম্বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে না।

আমরা মাঝে মাঝে ফুটপাত, রেল স্টেশনে, বাসটার্মিনালে বা বাজার ঘাটে কিছু কিছু পথশিশুকে সুমিষ্ট সুরে গান করতে শুনি। তাদের গলার স্বর আমাদের অবাক করে তোলে। একটু লক্ষ্য করলেই আমার দেখব যে, এরা কিন্তু কারও কাছ থেকে গান শিখেনি, এদের পরিবারে কোনো বাদ্যযন্ত্র নেই। এমনকি গান শোনার কোনো ব্যবস্থাও হয়তো নেই। এরা দোকানের টেলিভিশন থেকে বা অন্য কোনোভাবে গান শুনেই এত সুন্দর গান করতে পারে। একবার ভাবুন তো যদি তাদের জন্য সংঙ্গীত চর্চা করার সুন্দর ব্যবস্থা তাদের পরিবার, সরকার কিম্বা রাষ্ট্র করে দিতে পারতো তাহলে কী হতো! আমরা এমন একটা ব্যবস্থার মধ্যে বাস করছি যেখানে মেধাকে বিকাশ করার ন্যূনতম সুযোগের নিশ্চয়তাও নেই। যার ফলে আমরা দেখছি একটা ছোট ছেলে কিম্বা মেয়ে ভালো গান, নৃত্য কিম্বা অঙ্কন করতে পারলেও তাকে পূর্ণাঙ্গ শিক্ষার সুযোগ করে দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে সুযোগ যে নেই তা নয়। যাদের সুযোগ আছে তারা হয়তো টাকা খরব করে গান, নৃত্য কিম্বা চিত্রাঙ্কন শেখার জন্য সন্তানের পিছনে খরচ করতে চান না। তারা অন্য কিছু ভাবছেন। কিন্তু যাদের নাই তারা ইচ্ছা থাকার পর কোনো উপায় খুঁজে পান না। যদি আমাদের সমাজব্যবস্থাটা এমন হতো যে সবার জন্যই নিজের প্রতিভা অনুযায়ী শিক্ষার নিশ্চয়তা থাকতো তাহলে কতই না সুন্দর হতো। আমাদের দেশ কত গৌরবোজ্জ¦ অর্জনের অধিকারী হতে পারতো। কিন্তু এতই মন্দভাগ্য এতোই যে সবার জন্য শিক্ষা তো দূরে থাক দু বেলা খাবার ব্যবস্থা করতে পারিনি। এরকম আরও অনেক বিষয় রয়েছে যেমন, অনেকে আছে যারা রাজনীতিতে বেশ প্রতিভাবান কিন্তু কতিপয় মানুষের জন্য সেই সুযোগও নেই। এসব আমাদের ব্যর্থতা। তবে এই ব্যর্থতা নিয়ে বসে থাকলে চলবে না। সবাইকে এই পরিস্থিতি থেকে সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব এমন একটা সমাজ গঠনের চিন্তা করতে হবে।

এমন অনেক পরিবারে আছে, যারা তার সন্তানকে ভালোভাবে লেখাপড়া করাতে পারে না অর্থের অভাবে। সন্তানের অদম্য মেধা ও ইচ্ছা শক্তি থাকার পর শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারছে না। আমরা জানি করোনাকালে বাংলাদেশের ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থীর ক্ষতির সম্মুখীন। অনেক শিক্ষার্থী পড়াশোনা বাদ দিয়ে ইনকাম করতে নেমে পরেছে। এই যে ক্ষতি এটা আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের ক্ষতি। নিম্নবিত্তের দারিদ্র পরিবারগুলোর ক্ষতি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ব্যয়বহুল হওয়াই এমনিতেই দারিদ্র পরিবারের সন্তান উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে বেশি যেতে পারে না তার উপর যখন কোনো দুর্যোগ আসে সেটার প্রথম শিকার। একটা মেধা ঝরে পড়া একটা দেশের জন্য কত বড় ক্ষতি সেটা বুঝিয়ে বলা কঠিন। তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। শিশুরা কাদামাটির মতো। তাদেরকে গড়ে তুলতে হয়। এই গড়ে তোলার দায়িত্ব পরিবারের, সমাজের ও দেশের। কিন্তু আমাদের দেশের পরিবার চাইলেও প্রচলিত সমাজ ও দেশের যে ব্যবস্থা তাতে শিশুকে তার নিজের পছন্দের কিম্বা আগ্রহের ক্ষেত্র বুঝে গড়ে তোলার দায়িত্ব কেউ নিতে চায় না। 

কোন দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন সব ধরনের জনবল, যারা একটা দেশকে সবদিক থেকে পরিপূর্ণ করে তুলবে। সে জন্য প্রয়োজন আছে দক্ষ রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, চিকিৎসাবিদ, বিজ্ঞানী, শিল্পি, সাহিত্যিক, দার্শনিক। মোট কথা মানব সভ্যতার উন্নয়নের জন্য সব ক্ষেত্রে প্রকাশর গুণী-জ্ঞানী-প্রজ্ঞাবান মানুষের দরকার। আর এসব ভিন্ন ও বিচিত্র ধরনের প্রতিভা নিয়েই একটা শিশু জন্মগ্রহণ করে। পরিবার, সমাজ ও দেশ যখন তাকে পরিপূর্ণ বিকাশের সুযোগ করে দিতে পারে তখনই সেই পরিবার, সমাজ ও দেশ আলোকিত হয়। তাকেই উন্নত সমাজ কিম্বা দেশ বলে। কথায় বলে ‘ইচ্ছা থাকলে সমুদ্রের তলার স্বর্ণ নাকে উঠে আর ইচ্ছ না থাকলে নাকের স্বর্ণ সমুদ্র তলে ঢুবে’। আমরা যদি আমারে সমাজকে দেশকে গড়ে তুলতে চাই, প্রকৃত উন্নতির দিকে নিয়ে যেতে চাই, প্রত্যেক শিশুর স্বাধীন বিকাশ ও তার মেধাকে কাজে লাগানো মতো সমাজ চাই তাহলে তার জন্য আমাদের সবাইকে সেই লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। কোন এমন ব্যবস্থা রয়েছে যা সবার খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার অধিকার নিশ্চিত করে বা করতে পারে সেই ব্যবস্থাকেই প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর এর মাধ্যমেই আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব। যেখানে মানুষের খাদ্যের জন্য, শিক্ষার জন্য, মেধার বিকাশের জন্য হাহাকার করতে হবে না। মানুষের মেধা এমন সম্পদ যার কোনো মরণ নেই। এটি এমন অসি যার বিশ্ব জয় করতে জানে। 

মানুষের মেধা কোনো দল-মতের সম্পত্তি নয় এটা গোটা দেশ-জাতি ও বিশ্বের সম্পদ। প্রত্যেক মানব শিশুর সুন্দর ও সুষ্ঠু বিকাশের ব্যবস্থা অবশ্যই করতে হবে। কিন্তু আমার যে সমাজে বাস করছি সেখানে এই দায়িত্ব নেয়া কেউ আছে কী? বিপ্লবী কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘এসেছে নতুন শিশু/ তাকে ছেড়ে দিতে স্থান’। এই যে কবির আহ্বান সেই আহ্বান প্রত্যেক শিশুর জন্মগত অধিকার নিশ্চিত করার আহ্বান।


লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ